সূরা আন নূর (অর্থ, নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

নামকরণ

পঞ্চম রুকূ’র প্রথম আয়াত (আরবী) থেকে সূরা নাম গৃহীত হয়েছে ।

নাযিলের সময়-কাল

এ সূরাটি যে বনীল মুসতালিক যুদ্ধের সময় নাযিল হয়, এ বিষয়ে সবাই একমত । কুরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের ঘটনা প্রসংগে এটি নাযিল হয় । (দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকুতে এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে । আর সমস্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী বনীল মুসতালিক যুদ্ধের সফরের মধ্যে এ ঘটনাটি ঘটে । কিন্তু এ যুদ্ধটি ৫ হিজরী সনে আহযাব যুদ্ধের আগে, না ৬ হিজরীতে আহযাব যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয় সে ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা যায় । আসল ঘটনাটি কি? এ ব্যাপারে অনুসন্ধানের প্রয়োজন এ জন্য দেখা দিয়েছে যে, পরদার বিধান কুরআন মজীদের দু’টি সূরাতেই বর্ণিত হয়েছে । এর মধ্যে একটি সূরা হচ্ছে এটি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সূরা আহযাব । আর আহযাব যুদ্ধের সময় সূরা আহযাব নাযিল হয় এ ব্যাপারে কারোর দ্বিমত নেই । এখন যদি আহযাব যুদ্ধ প্রথমে হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, পরদার বিধানের সূচনা হয় সূরা আহযাবে নাযিলকৃত নির্দেশসমূহের মাধ্যমে এবং তাকে পূর্ণতা দান করে এ সূরায় বর্ণিত নির্দেশগুলো । আর যদি বনীল মুসতালিক যুদ্ধ প্রথমে হয়ে থাকে তাহলে বিধানের বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায় । এ ক্ষেত্রে সূচনা সূরা নূর থেকে এবং তার পূর্ণতা সূরা আহযাবে বর্ণিত বিধানের মাধ্যমে বলে মেনে নিতে হয় । এভাবে হিজাব বা পরদার বিধানে ইসলামী আইন ব্যবস্থার যে যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে তা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে । এ উদ্দেশ্য আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আগে নাযিলের সময়কালটি অনুসন্ধান করে বের করে নেয়া জরুরী মনে করি ।

ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন বনীল মুসতালিক যুদ্ধ হিজরী ৫ সনের শাবান মাসে অনুষ্ঠিত হয় এবং তারপর ঐ বছরেরই যিলকাদ মাসে সংঘটিত হয় ইহযাব (বা খন্দক) যুদ্ধ । এর সমর্থনে সবচেয়ে বড় সাক্ষ হচ্ছে এই যে, হযরত আয়েশার রিরুদ্ধে মিথ্যাচারের ঘটনা প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) থেকে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর কোন কোনটিতে হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ (রা) ও হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের (রা) বিবাদের কথা পাওয়া যায় । আর সমস্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস অনুযায়ী হযরত সা’দ ইবনে মু’আযের ইন্তিকাল হয় বনী কুরাইযা যুদ্ধে । আহযাব যু‌দ্ধের পরপরই এ যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয় । কাজেই ৬ হিজরীতে তাঁর উপস্থিত থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই ।
অন্যদিকে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, আহযাব যুদ্ধ ৫ হিজরীর শওয়াল মাসের ঘটনা এবং বনীল মুসতালিকের যুদ্ধ হয় ৬ হিজরীর শাবান মাসে । এ প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) ও অন্যান্য লোকদের থেকে যে অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো এর সমর্থন করে । সেগুলো থেকে জানা যায়, মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পূর্বে হিজাব বা পরদার বিধান নাযিল হয় আর এ বিধান পাওয়ার যায় সূরা আহযাবে । এ থেকে জানা যায়, সে সময় হযরত যয়নবের (রা) সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং এ বিয়ে ৫ হিজরীর যিলকদ মাসের ঘটনা । সূরা আহযাবে এ ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায় । এ ছাড়া এ হাদীসগুলো থেকে একথাও জানা যায় যে, হযরত যয়নবের (রা) বোন হামনা বিনতে জাহশ হযরত আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ানোয় শুধুমাত্র এ জন্য অংশ নিয়েছিলেন যে, হযরত আয়েশা তাঁর বোনের সতিন ছিলেন । আর একথা সুস্পষ্ট যে, বোনের সতিনে বিরুদ্ধে এ ধরনের মনোভাব সৃষ্টি হবার জন্য সতিনী সম্পর্ক শুরু হবার পর কিছুকাল অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। এসব সাক্ষ ইবনে ইসহাকের বর্ণনাকে শক্তিশালী করে দেয় ।

মিথ্যাচারের ঘটনার সময় হরত সা’দ ইবনে মু’আযের (রা) উপস্থিত বর্ণনা থাকাটাই এ বর্ণনাটি মেনে নেবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু এ ঘটনা প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) থেকে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে হযরত সা’দা ইবনে মু’আযের কথা বলা হয়েছে আবার কোনটিতে বলা হয়েছে তাঁর পরিবর্তে হযরত উসাইদ ইবনে হুদ্বাইরের (রা) কথা , এ জিনিসটিই এ সংকট দূর করে দেয় । আর এ দ্বিতীয় বর্ণনাটি এ প্রসংগে হযরত আয়েশা বর্ণিত অন্যান্য ঘটনাবলীর সাথে পুরোপুরি খাপখেয়ে যায় । অন্যথায় নিছক সা’দ ইবনে মু’আযের জীবনকালের সাথে খাপ খাওয়াবার জন্য যদি বনীল মুসতালিক যুদ্ধ ও মিথ্যাচারের কাহিনীকে আহযাব ও কুরাইযা যুদ্ধের আগের ঘটনা বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে তো হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়া ও যয়নবের (রা) বিয়ের ঘটনা তার পূর্বে সংঘটিত হওয়া উচিত ছিল । এ অবস্থায় এ জটিলতার গ্রন্থী উন্মোচন করা কোনক্রমেই সম্ভব হয় না । অথচ কুরআন ও অসংখ্য সহীহ হাদীস উভয়ই সাক্ষ দিচ্ছে যে, যয়নবের (রা) বিয়ে ও হিজাবের হুকুম আহযাব ও কুরাইযার পরবর্তী ঘটনা । এ কারণেই ইবনে হাযম ও ইবনে কাইয়েম এবং অন্য কতিপয় গবেষক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনাকেই সঠিক গণ্য করেছেন এবং আমরাও একে সঠিক মনে করি ।

ঐতিহাসিক পটভূমি

এখন অনুসন্ধানের মাধ্যমে একথা প্রমাণিত হবার পর যে, সূরা নূর ৬ হিজরীর শেষার্ধে সূরা আহযাবের কয়েক মাস পর নাযিল হয়, যে অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হয় তার ওপর আ‌মাদের একটু নজর বুলিয়ে নেয়া উচিত । বদর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর আরবে ইসলামী আন্দোলনের যে উত্থান শুরু হয় খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতেই তা এত বেশী ব্যাপকতা লাভ করে যার ফলে মুশরিক, ইহুদী, মুনাফিক ও দোমনা সংশয়ী নির্বিশেষে সবাই একথা অনুভব করতে থাকে যে, এ নব উত্থিত শক্তিটিকে শুধুমাত্র অস্ত্র ও সমর শস্তির মাধ্যমে পরাস্ত করা যেতে পারে না । খন্দকের যুদ্ধে তারা এক জোট হয়ে দশ হাজার সেনা নিয়ে মদীনা আক্রমণ করেছিল । কিন্তু মদীনা উপকণ্ঠে এক মাস ধরে মাথা কুটবার পর শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চলে যায় । তাদের ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করে দেনঃ

————————————-(আরবী)

“এ বছরের পর কুরাইশরা আর তোমাদের ওপর হামলা করবে না বরং তোমরা তাদের ওপর হামলা করবে । ”(ইবনে হিশাম ২৬৬ পৃষ্ঠা) ।

রসূল (সা)-এর এ উক্তি দ্বারা প্রকারান্তরে একথাই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির অগ্রগতির ক্ষমতা নিশেষ হয়ে গেছে,এবার থেকে ইসলাম আর আত্মরক্ষার নয় বরং অগ্রগতির লড়াই লড়বে এবং কুফরকে অগ্রগতির পরিবর্তে আত্মরক্ষার লড়াই লড়তে হবে । এটি ছিল অবস্থার একেবারে সঠিক ও বাস্তব বিশ্লেষণ । প্রতিপক্ষও ভালোভাবে এটা অনুভব করছিল ।
মুসলমানদের সংখ্যা ইসলামের এ উত্তরোত্তর উন্নতির আসল কারণ ছিল না । বদর থেকে খন্দক পর্যন্ত প্রত্যেক যুদ্ধে কাফেররা তাদের চাইতে বেশী শক্তির সমাবেশ ঘটায় । অন্যদিকে জনসংখ্যার দিক দিয়েও সে সময় মুসলমানরা আরবে বড় জোর ছিল দশ ভাগের এক ভাগ । মুসলমানদের উন্নত মানের অস্ত্রসম্ভারও এ উন্নতির মূল কারণ ছিল না । সব ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামে কাফেরদের পাল্লা ভারী ছিল । অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়েও তাদের সাথে মুসলমানদের কোন তুলনাই ছিল না । কাফেরদের কাছে ছিল সমস্ত আরবের আর্থিক উপায় উপকরণ । অন্যদিকে মুসলমানরা অনাহারে মরছিল । কাফেরদের পেছনে ছিল সমগ্র আরবের মুশরিক সমাজ ও আহলি কিতাব গোত্রগুলো । অন্যদিকে মুসলমানরা একটি নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে পুরাতন ব্যবস্থার সকল সমর্থকের সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল । এহেন অবস্থায় যে জিনিসটি মুসলমানদের ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেটি ছিল আসলে তাদের চারিত্রিক ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব । ইসলামের সকল শত্রু দলই এটা অনুভব করছিল । একদিকে তারা দেখছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের নির্মল নিষ্কলুষ চরিত্র । এ চরিত্রের পবিত্রতা, দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তার মানুষের হৃদয় জয় করে চলছে । অন্যদিকে তারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নৈতিক পবিত্রতা মুসলমানদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য, শৃংখলা ও সংহতি সৃষ্টি করে দিয়েছে এবং এর সামনে মুশরিকদের শিথিল সামাজিক ব্যবস্থাপনা যুদ্ধ ও শান্তি উভয় অবস্থায়ই পরাজয় বরণ করে চলছে ।

নিকৃষ্ট স্বভাবের লোকদের বৈশিষ্ট হচ্ছে এই যে, তাদের চোখে যখন অন্যের গুণাবলী ও নিজেদের দুর্বলতাগুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে এবং তারা এটাও যখন বুঝতে পারে যে, প্রতিপক্ষের সৎগুণাবলী তাকে এগিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের নিজেদের দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে প্রতিপক্ষের গুণাবলীর আয়ত্ব করে নেবার চিন্তা জাগে না, বরং তারা চিন্তা করতে থাকে যেভাবেই হোক নিজেদের অনুরূপ দুর্বলতা তার মধ্যেও ঢুকিয়ে দিতে হবে । আর এটা সম্ভব না হলে কমপক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালাতে হবে, যাতে জনগণ বুঝতে পারে যে, প্রতিপক্ষের যত গুণই থাক, সেই সাথে তাদের কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটিও আছে । এ হীন মানসিকতাই ইসলামের শত্রুদের কর্মতৎপরতার গতি সামরিক কার্যক্রমের দিক থেকে সরিয়ে নিকৃষ্ট ধরনের নাশকতা ও আভ্যন্তরীণ গোলযোগ সৃষ্টির দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছে । আর যেহেতু এ কাজটি বাইরের শত্রুদের তুলনায় মুসলমানদের ভেতরের মুনাফিকরা সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারতো তাই পরিকল্পিতভাবে বা পরিকল্পনা ছাড়াই স্থিরিকৃত হয় যে, মদীনার মুনাফিকরা ভেতর থেকে গোলমাল পাকাবে এবং ইহুদী ও মুশরিকরা বাইর থেকে তার ফলে যত বেশি পারে লাভবান হবার চেষ্টা করবে ।
৫ হিজরী যিলকদ মাসে ঘটে এ নতুন কৌশলটির প্রথম আত্মপ্রকাশ । এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরব থেকে পালক পুত্র * সংক্রান্ত জাহেলী রীতি নির্মূল করার জন্য নিজেই নিজের পালক পুত্রের [যায়েদ (রা) ইবনে হারেস] তালাক দেয়া স্ত্রীকে [যয়নব (রা) বিনতে জাহশ] বিয়ে করেন । এ সময় মদীনার মুনাফিকরা অপপ্রচারের এক বিরাট তাণ্ডব সৃষ্টি করে । বাইর থেকে ইহুদী ও মুশরিকরাও তাদের কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে মিথ্যা অপবাদ রটাতে শুরু করে । তারা অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প তৈরী করে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে । যেমন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে তার পালক পুত্রের স্ত্রীকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যান (নাউযুবিল্লাহ) । কিভাবে পুত্র তাঁর প্রেমের খবর পেয়ে যায় এবং তার পর নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার ওপর থেকে নিজের অধিকার প্রত্যাহার করে; তারপর কিভাবে তিনি নিজের পুত্রবধূকে বিয়ে করেন । এ গল্পগুলো এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, মুসলমানরাও এগুলোর প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি । এ কারণে মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরদের একটি দল হযরত যয়নব ও যায়েদের সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন সেগুলো মধ্যে আজো ঐসব মনগড়া গল্পের অংশ পাওয়া যায় । পশ্চিমের প্রাচ্যবিদরা খুব ভালো করে লবণ মরিচ মাখিয়ে নিজেদের বইতে এসব পরিবেশন করেছেন । অথচ হযরত যয়নব (রা) ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপন ফুফুর (উমাইমাহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব) মেয়ে । তাঁর সমগ্র শৈশব থেকে যৌবনকাল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চোখের সামনে অতিবাহিত হয়েছিল । তাঁকে ঘটনাক্রমে একদিন দেখে নেয়া এবং নাউযুবিল্লাহ তাঁর প্রেমে পড়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই দেখা দেয় না । আবার এ ঘটনার মাত্র এক বছর আগে নবী (সা) নিজেই চাপ দিয়ে তাঁকে হযরত যায়েদকে (রা) বিয়ে করতে বাধ্য করেন । তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এ বিয়েতে অসন্তুষ্ট ছিলেন । হযরত যয়নব (রা) নিজেও এতে রাজী ছিলেন না । কারণ কুরাইশদের এক শ্রেষ্ঠ অভিজাত পরিবারের মেয়ে একজন মুক্তিপ্রাপ্ত গোলামের পত্নী হওয়াকে স্বভাবতই মেনে নিতে পারতো না । কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবলমাত্র মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার সূচনা নিজের পরিবার থেকে শুরু করার জন্যই হযরত যয়নবকে (রা) এ বিয়েতে রাজী হতে বাধ্য করেন । এসব কথা বন্ধু ও শত্রু সবাই জানতো । আর এ কথাও সবাই জানতো, হযরত যয়নবের বংশীয় আভিজাত্যবোধই তাঁর ও যায়েদ ইবনে হারেসার মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক স্থায়ী হতে দেয়নি এবং শেষ পর্যন্ত তালাক হয়ে যায় । কিন্তু এসব সত্ত্বেও নির্লজ্জ মিথ্যা অপবাদকারীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের ওপর জঘন্য ধরনের নৈতিক দোষারোপ করে এবং এত ব্যাপক আকারে সেগুলো ছড়ায় যে, আজো পর্যন্ত তাদের এ মিথ্যা প্রচারণার প্রভাব দেখা যায় ।
*অন্যের পুত্রকে নিজের পুত্র বানিয়ে নেয়া এবং পরিবারের মধ্যে তাকে পুরোপুরি ঔরশজাত সন্তানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা ।

এরপর দ্বিতীয় হামলা করা হয় বনীল মুসতালিক যুদ্ধের সময় । প্রথম হামলার চাইতে এটি ছিল বেশী মারাত্মক । বনীল মুসতালিক গোত্রটি বনী খুযা’আর একটি শাখা ছিল । তারা বাস করতো লোহিত সাগর উপকূলে জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে কুদাইদ এলাকায় । যে ঝরণাধারাটির আশপাশে এ উপজাতীয় লোকেরা বাস করতো তার নাম ছিল মরাইসী । এ কারণে হাদীসে এ যুদ্ধটিকে মুরাইসী’র যুদ্ধও বলা হয়েছে । চিত্রের মাধ্যমে তাদের সঠিক অবস্থানস্থল জানা যেতে পারে ।

৬ হিজরীর শাবান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পান, তারা মুসলমানদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং অন্যান্য উপাজাতিরকেও একত্র করার চেষ্টা করছে । এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে তিনি ষড়যন্ত্রটিকে অংকুরেই গুঁড়িয়ে দেবার জন্য একটি সেনাদল নিয়ে সেদিকে রওয়ানা হয়ে যান । এ অভিযানে আবুদল্লাহ ইবনে উবাইও বিপুল সংখ্যক মুনাফিকদের নিয়ে তাঁর সহযোগী হয় । ইবনে সা’দের বর্ণনা মতে, এর আগে কোন যুদ্ধেই মুনাফিকরা এত বিপুল সংখ্যায় অংশ নেয়নি । মুরাইসী নামক স্থানে রসূলুল্লাহ (সা) হঠাৎ শত্রুদের মুখোমুখি হন । সামান্য সংঘর্ষের পর যাবতীয় সম্পদ-সরঞ্জাম সহাকারে সমগ্র গোত্রটিকে গ্রেফতার করে নেন । এ অভিযান শেষ হবার পর তখনো মুরাইসীতেই ইসলামী সেনা দল অবস্থান করছিল এমন সময় একদিন হযরত উমরের (রা) একজন কর্মচারী (জাহজাহ ইবনে মাসউদ গিফারী) এবং খাযরাজ গোত্রের একজন সহযোগীর (সিনান ইবনে ওয়াবর জুহানী) মধ্যে পানি নিয়ে বিরোধ বাধে । একজন আনসারদেরকে ডাকে এবং অন্যজন মুহাজিরদেরকে ডাক দেয় । উভয় পক্ষ থেকে লোকেরা একত্র হয়ে যায় এবং ব্যাপারটি মিটমাট করে দেয়া হয় । কিন্তু আনসারদের খাযরাজ গোত্রের সাথে সম্পর্কিত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তিলকে তাল করে দেয় । সে আনসারদেরকে একথা বলে উত্তেজিত করতে থাকে যে, “এ মুহাজিররা আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমাদের এবং এ কুরাইশী কাঙালদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, কুকুরকে লালন পালন করে বড় করো যাতে সে তোমাকেই কামড়ায় । এসব কিছু তোমাদের নিজেদেরই কর্মফল । তোমরা নিজেরাই তাদেরকে ডেকে এনে নিজেদের এলাকয় জায়গা দিয়েছো এবং এবং নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে তাদেরকে অংশীদার বানিয়েছো । আজ যদি তোমরা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে দেখবে তারা পগার পার হয়ে গেছে । ” তারপর সে কসম খেয়ে বলে, “মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা সম্পন্ন তারা দীন-হীন-লাঞ্ছিতদেরকে বাইরে বের করে দেবে । ” * তার এসব কথাবার্তার খবর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছুলে হযরত উমর (রা) তাঁকে পরামর্শ দেন, এ ব্যক্তিকে হত্যা করা হোক । কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ (আরবী) (হে উমর! দুনিয়ার লোকেরা কি বলবে? তারা বলবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিজেরই সংগী-সাথীদেরকে হত্যা করছে । ) তারপর তিনি তখনই সে স্থান থেকে রওয়ানা হবার হুকুম দেন এবং দ্বিতীয় দিন দুপুর পর্যন্ত কোথাও থামেননি, যাতে লোকেরা খুব বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং কারোর এক জায়গায় বসে গল্পগুজব করার এবং অন্যদের তা শোনার অবকাশ না থাকে । পথে উসাইদ ইবনে হুদ্বাইর (রা) বলেন, “হে আল্লাহর নবী! আজ আপনি নিজের স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে অসময়ে রওয়ানা হবার হুকুম দিয়েছেন? তিনি জবাব দেন , “তুমি শোননি তোমাদের সাথী কিসব কথা বলছে?” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “কোন সাথী?” জবাব দেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই । ” তিনি বলেন, “হে আল্লাহর রসূল! ঐ ব্যক্তির কথা বাদ দিন । আপনি যখন মদীনায় আগমন করেন তখন আমরা তাকে নিজেদের বাদশাহ বানাবার ফায়সালা করেই ফেলেছিলাম এবং তার জন্য মুকুট তৈরী হচ্ছিল । আপনার আগমনের ফলে তার বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে । তারই ঝাল সে ঝাড়ছে” ।

*সূরা মুনাফিকুনে আল্লাহ নিজেই তার এ উক্তিটি উদ্বৃত করেছেন।

এ হীন কারসাজির রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি । এরি মধ্যে একই সফরে সে আর একটি ভয়াবহ অঘটন ঘটিয়ে বসে । এমন পর্যায়ের ছিল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর নিবেদিত প্রাণ সাহাবীগণ যদি পূর্ণ সংযম ধৈর্যশীলতা এবং জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিতেন তাহলে মদীনার এ নবগঠিত মুসলিম সমাজটিতে ঘটে যেতো মারাত্মক ধরনের গৃহযুদ্ধ । এটি ছিল হযরত আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের ফিতনা । এ ঘটনার বিবরণ হযরত আয়েশার মুখেই শুনুন । তাহলে যথার্থ অবস্থা জানা যাবে । মাঝখানে যেসব বিষয় ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হবে সেগুলো আমি অন্যান্য নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে ব্রাকেটের মধ্যে সন্নিবিশেতি করে যেতে থাকবো । এর ফলে হযরত আয়েশার (রা) বর্ণনার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে না । তিনি বলেনঃ

“রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল, যখনই তিনি সফরে যেতেন তখনই স্ত্রীদের মধ্য থেকে কে তাঁর সংগে যাবে তা ঠিক করার জন্য লটারী করতেন । ” *বনীল মুসতালিক যুদ্ধের সময় লটারীতে আমার নাম ওঠে । ফলে আমি তাঁর সাথী হই । ফেরার সময় আমরা যখন মদীনার কাছাকাছি এসে গেছি তখন এক মনযিলে রাত্রিকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেলার যাত্রা বিরত্রি করেন । এদিকে রাত পোহাবার তখনো কিছু সময় বাকি ছিল এমন সময় রওয়ানা দেবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় । আমি উঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য যাই । ফিরে আসার সময় অবস্থান স্থলের কাছাকাছি এসে মনে হলো আমার গলার হারটি ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে । আমি তার খোঁজে লেগে যাই । ইত্যবসরে কাফেলা রওয়ানা হয়ে যায় । নিয়ম ছিল, রওয়ানা হবার সময় আমি নিজের হাওদায় বসে যেতাম এবং চারজন লোক মিলে সেটি উঠিয়ে উঠের পিঠে বসিয়ে দিতো । সে যুগে আমরা মেয়েরা কম খাবার কারণে বড়ই হালকা পাতলা হতাম । আমার হাওদা উঠাবার সময় আমি যে তার মধ্যে নেই একথা লোকেরা অনুভবই করতে পারেনি । তারা না জেনে খালি হাওদাটি উঠিয়ে উঠের পিঠে বসিয়ে দিয়ে রওয়ানা হয়ে যায় । আমি হার নিয়ে ফিরে এসে দেখি সেখানে কেউ নেই । কাজেই নিজের চাদর মুড়ি দিয়ে আমি সেখানেই শুয়ে পড়ি । মনে মনে ভাবি, সামনের দিকে গিয়ে আমাকে হাওদার মধ্যে না পেয়ে তারা নিজেরাই খুঁজতে খুঁজতে আবার এখানে চলে আসবে । এ অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি ।
সকালে সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল সালামী আমি যেখানে শুয়ে ছিলাম সেখানে দিয়ে যেতে থাকেন । তিনি আমাকে দেখতেই চিনে ফেলেন । কারণ পরদার হুকুম নাযিল হবার পূর্বে তিনি আমাকে বহুবার দেখেন । (তিনি ছিলেন একজন বদরী সাহাবী । সকালে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকা ছিল তাঁর অভ্যাস । **তাই তিনিও সেনা শিবিরের কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং এখন ঘুম থেকে উঠে মদীনার দিকে রওয়ানা দিয়েছিলেন । ) আমাকে দেখে তিনি উট থামিয়ে নেন এবং স্বতষ্ফূর্তভাবে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে, (আরবী) “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী এখানে রয়ে গেছেন । ” তাঁর এ আওয়াজে আমার চোখ খুলে যায় এবং আমি উঠে সংগে সংগেই আমার মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে নিই । তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি, সোজা তাঁর উটটি এনে আমার কাছে বসিয়ে দেন এবং নিজে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন । আমি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাই এবং তিনি উটের রশি ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন । দুপুরের কাছাকাছি সময়ে আমরা সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেই । সে সময় সেনাদল এক জায়গায় গিয়ে সবেমাত্র যাত্রা বিরতি শুরু করেছে । তখনো তারা টেরই পায়নি আমি পেছনে রয়ে গেছি । এ ঘটনার কুচক্রীরা মিথ্যা অপবাদ রটাতে থাকে এবং এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল সবার আগে । কিন্তু আমার সম্পর্কে কিসব কথাবার্তা হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ ।

* এ লটারীর ধরনটি প্রচলিত লটারীর মতো ছিলো না । আসলে সকল স্ত্রীর অধিকার সমান ছিল । তাদের একজনকে অন্যজনের প্রাধান্য দেবার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল না । এখন যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই কাউকে বেছে নিতেন তাহলে স্ত্রীরা মনে ব্যাথা পেতেন এবং এতে পারস্পরিক রেষারেষি ও বিদ্বেষ সৃষ্টির আংশকা থাকতো। তাই তিনি লটারীর মাধ্যমে এর ফয়সালা করতেন । শরীয়তে এমন অবস্থার জন্য লটারীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে । যখন কতিপয় লোকের বৈধ অধিকার হয় একেবারে সমান সমান এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে অন্যজনের ওপর অগ্রাধিকার দেবার কোন ন্যায়সংগত কারণ থাকে না অথচ অধিকার কেবল মাত্র একজনকে দেয়া যেতে পারে।
** আবু দাউদ ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থে এ আলোচনা এসেছে, তাঁর স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেন যে, তিনি কখনো ফজরের নামায যথা সময় পড়েন না । তিনি ওজর পেশ করেন, হে আল্লাহর রসূল! এটা আমার পারিবারিক রোগ । সকালে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার এ দূর্বলতাটি আমি কিছুতেই দূর করতে পারি না। একথায় রসূলূল্লাহ (সা) বলেনঃ ঠিক আছে, যখনই ঘুম ভাঙবে, সংগে সংগে নামাজ পড়ে নিবে। কোন কোন মুহাদ্দিস তাঁর কাফেলার পেছনে থেকে যাওয়ার এ কারণ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস এর কারণ বর্ণনা করে বলেন, রাতের অন্ধকারে রওয়ানা হবার কারণে যদি কারোর কোণ জিনিস পেছনে থেকে গিয়ে থাকে তাহলে সকালে তা খুঁজে নিয়ে আসার দায়িত্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওপর অর্পণ করেছিলেন ।

[অন্যান্য হাদীসে বলা হয়েছে, সে সময় সফওয়ানের উটের পিঠে চড়ে হযরত আয়েশা (রা) সেনা শিবিরে এসে পৌঁছেন এবং তিনি এভাবে পেচনে রয়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার করে ওঠে, “আল্লাহর কসম, এ মহিলা নিষ্কলংক অবস্থায় আসেনি । নাও, দেখো তোমাদের নবীর স্ত্রী আর একজনের সাথে রাত কাটিয়েছে এবং সে এখন তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে চলে আসছে । ”]

মদীনায় পৌঁছেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং প্রায় এক মাসকাল বিছানায় পড়ে থাকি । শহরে এ মিথ্যা অপবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ে । রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানেও কথা আসতে থাকে । কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না । তবে যে জিনিসটি আমার মনে খচখচ করতে থাকে তা হচ্ছে এই যে, অসুস্থ অবস্থায় যে রকম দৃষ্টি দেয়া দরকার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টি আমার প্রতি তেমন ছিল না । তিনি ঘরে এলে ঘরের লোকদের জিজ্ঞেস করতেন (আরবী) (ও কেমন আছে?)
নিজে আমার সাথে কোন কথা বলতেন না । এতে আমার মনে সন্দেহ হতো, নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার ঘটেছে । শেষে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি নিজের মায়ের বাড়িতে চলে গেলাম যাতে তিনি আমার সেবা শুশ্রূষা ভালোভাবে করতে পারেন ।

এক রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য আমি মদীনার বাইরে যাই । সে সময় আমাদের বাড়িঘরে এ ধরনের পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না । ফলে আমরা পায়খানা করার জন্য বাইরে জংগলের দিকে যেতাম । আমার সাথে ছিলেন মিসতাহ ইবনে উসাসার মা । তিনি ছিলেন আমার মায়ের খালাত বোন । [অন্য হাদীস থেকে জানা যায়, তাদের সমগ্র পরিবারের ভরণপোষণ হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রা) জিম্মায় ছিল । কিন্তু এ সত্ত্বেও মিসতাহ এমন লোকদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন যারা হযরত আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছিল । ] রাস্তায় তাঁর পায় ঠোকর লাগে এবং তিনি সংগে সংগে স্বতষ্ফূর্তভাবে বলে ওঠেনঃ “ধ্বংস হোক মিসতাহ । ” আমি বললাম, “ভালই মা দেখছি আপনি, নিজের পেটের ছেলেকে অভিশাপ দিচ্ছেন, আবার ছেলেও এমন যে বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে । ” তিনি বলেন, “মা, তুমি কি তার কথা কিছুই জানো না?” তারপর তিনি গড়গড় করে সব কথা বলে যান । তিনি বলে যেতে থাকেন, মিথ্যা অপবাদদাতারা আমার বিরুদ্ধে কিসব কথা রটিয়ে বেড়াচেছ । [মুনাফিকরা ছাড়া মুসলমানদের মধ্য থেকেও যারা এ ফিতনায় শামিল হয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে মিসতাহ, ইসলামের প্রখ্যাত কবি হাসসান ইবনে সাবেত ও হযরত যয়নবের (রা) বোন হামনা বিনতে জাহশের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য । ] এ কাহিনী শুনে আমার শরীরের রক্ত যেন শুকিয়ে গেল । যে প্রয়োজন কারণের জন্য আমি বের হয়েছিলাম তাও ভুলে গেলাম । সোজা ঘরে চলে এলাম । সারা রাত আমার কাঁদতে কাঁদতে কেটে যায় । ”

সামনের দিকে এগিয়ে হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ “আমি চলে আসার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী (রা) ও উসামাহ ইবনে যায়েদকে (রা) ডাকেন । তাদের কাছে পরামর্শ চান । উসামাহ (রা) আমার পক্ষে ভালো কথাই বলে । সে বলে, ‘হে আল্লাহর রসূল! ভালো জিনিস ছাড়া আপনার স্ত্রীর মধ্যে আমি আর কিছুই দেখিনি । যা কিছু রটানো হচ্ছে সবই মিথ্যা ও বানোয়াট ছাড়া আর কিছুই নয় । ’ আর আলী (রা) বলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মেয়ের অভাব নেই । আপনি তাঁর জায়গায় অন্য একটি মেয়ে বিয়ে করতে পারেন । আর যদি অনুসন্ধান করতে চান তাহলে সেবিকা বাঁদীকে ডেকে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করুন । ’ কাজেই সেবিকাকে ডাকা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হয় । সে বলে, ‘সে আল্লাহর কসম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে এমন কোন খারাপ জিনিস দেখিনি যার ওপর অংগুলি নির্দেশ করা যেতে পারে । তবে এতটুকু দোষ তাঁর আছে যে, আমি আটা ছেনে রেখে কোন কাজে চলে যাই এবং বলে যাই, বিবি সাহেবা! একটু আটার দিকে খেয়াল রাখবেন, কিন্তু তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং বকরি এসে আটা খেয়ে ফেলে । ’ সেদিনই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবায় বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! এক ব্যক্তি আমার পরিবারের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে আমাকে অশেষ কষ্ট দিচ্ছে! তোমাদের মধ্যে কে আছে যে, তার আক্রমণ থেকে আমার ইজ্জত বাঁচাতে পারে? আল্লাহর কসম, আমি তো আমার স্ত্রীর মধ্যেও কোন খারাপ জিনিস দেখিনি এবং সে ব্যক্তির মধ্যেও কোন খারাপ জিনিস দেখিনি যার সম্পর্কে অপবাদ দেয়া হচ্ছে । সে তো কখনো আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাড়ীতে আসেনি । ’ একথায় উসাইদ ইবনে হুদ্বাইর (কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী সা’দ ইবনে মু’আয) * উঠে বলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! যদি সে আমাদের গোত্রের লোক হয় তাহলে আমরা তাকে হত্যা করবো আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজদের লোক হয় তাহলে আপনি হুকুম দিন আমরা হুকুম পালন করার জন্য প্রস্তুত । ’ একথা শুনতেই খাযরাজ প্রধান সা’দ ইবনে উবাদাহ (রা) দাঁড়িয়ে যান এবং বলতে থাকেন , ‘মিথ্যা বলছো, তোমরা তাকে কখনোই হত্যা করতে পারো না । তোমরা তাকে হত্যা করার কথা শুধু এ জন্যই মুখে আনছো যে সে খাযরাজদের অন্তরভুক্ত । যদি সে তোমাদের গোত্রের লোক হতো তাহলে তোমরা কখনো একথা বলতে না, আমরা তাকে হত্যা করবো । ’ ** উসাইদ ইবনে হুতাইর জবাব দেন, ‘তুমি মুনাফিক, তাই মুনাফিকদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছো । ’ একথায় মসজিদে নববীতে একটি হাংগামা শুরু হয়ে যায় । অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে বসে ছিলেন । মসজিদের মধ্যেই আওস ও খাযরাজের লড়াই বেঁধে যাবার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে শান্ত করেন এবং তারপর তিনি মিম্বার থেকে নেমে আসেন । ”

“* সম্ভবত নামের ক্ষেত্রে এ বিভিন্নতার কারণ এ যে, হযরত আয়েশা (রা) নাম উল্লেখ করার পরিবর্তে আওস সরদার শব্দ ব্যবহার করে থাকবেন । কোন বর্ণনাকারী এ থেকে সা’দ ইবনে মু’আয মনে করেছেন । কারণ নিজের জীবদ্দশায় তিনিই ছিলেন আওস গোত্রের সরদার এবং ইতিহাসে আওস সরদার হিসেবে তিনিই বেশী পরিচিত। অথচ আসলে এ ঘটনার সময় তাঁর চাচাত ভাই উসাইদ ইবনে হুদাইর ছিলেন আওসের সরদার।

** হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ যদিও অত্যন্ত সৎ ও মুখলিস মুসলমান ছিলেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পোষন করতেন এবং মদীনায় যাদের সাহায্যে ইসলাম বিস্তার লাভ করে তাদের মধ্যে তিনিও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তবুও এতসব সৎ গুন সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে স্বজাতিপ্রীতি ও জাতীয় স্বার্থবোধ (আর আরবে সে সময় জাতি বলতে গোত্রই বুঝাতো) ছিল অনেক বেশী । এ কারণে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমরের পৃষ্টপোষকতা করেন, যেহেতু সে ছিল তার গোত্রের লোক । এ কারণে মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর মুখ থেকে এ কথা বের হয়ে যায়ঃ ————————————————-(আজ ও রক্ত প্রবাহের দিন । আজ এখানে হারামকে হালাল করা হবে । ) এর ফলে ক্রোধ প্রকাশ করে রসূলুল্লাহ (সা) তাঁর কাছ থেকে সেনাবাহিনীর ঝান্ডা ফিরিয়ে নেন । আবার এ কারণেই তিনি রসূলুল্লাহর (সা) ইন্তিকালের পর সাকীফায়ে বনি সায়েদায় খিলাফত আনসারদের হক বলে দাবী করেন। আর যখন তাঁর কথা অগ্রাহ্য করে আনসার ও মুজাহির সবাই সম্মিলিতভাবে হযরত আবু বকরের (রা) হাতে বাইআত করেন তখন তিনি একাই বাই’আত করতে অস্বীকার করেন। আমৃত্যু তিনি কুরাইশী খলীফায় খিলাফত স্বীকার করেননি । (দেখুন আল ইসাবাহ লিইবনে হাজার এবং আল ইসতিআব লিইবনে আবদিল বার এবং সা’দ ইবনে উবাদাহ অধ্যায়, পৃষ্টা ১০-১১ )

হযরত আয়েশার (রা) অবশিষ্ট কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ আমি এতদসংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে বণৃনা করবো যেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর ত্রুটি মুক্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে । এখানে আমি যা কিছু বলতে চাই তা হচ্ছে এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এ অপবাদ রটিয়ে একই গুলীতে কয়েকটি পাখি শিকার করার প্রচেষ্টা চালায় । একদিকে সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীকের (রা) ইজ্জতের ওপর হামলা চালায় অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলনের উন্নততর নৈতিক মর্যাদা ও চারিত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করে । তৃতীয় সে এর মাধ্যমে এমন একটি অগ্নিশিখা প্রজ্জলিত করে যে, যদি ইসলাম তার অনুসারীদের জীবন ও চরিত্র সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে না ফেলে থাকতো তাহলে মুহাজির ও আনসার এবং স্বয়ং আনসারদেরই দু’টি গোত্র পরস্পর লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যেতো ।”

বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় বিষয়

এ ছিল সে সময়কার পরিস্থিতি । এর মধ্যে প্রথম হামলার সময় সূরা আহযাবের শেষ ৬টি রুকূ’ নাযিল হয় এবং দ্বিতীয় হামলার সময় নাযিল হয় সূরা নূর । এ পটভূমি সামনে রেখে এ দু’টি সূরা পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করলে এ বিধানগুলোর মধ্যে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিহিত রয়েছে তা ভালোভাবে অনুধাবন করা যায় ।

মুনাফিকরা মুসলমানদেরকে এমন এক ময়দানে পরাজিত করতে চাচ্ছিল যেটা ছিল তাদের প্রাধান্যের আসল ক্ষেত্র । আল্লাহ তাদের চরিত্রে হননমূলক অপবাদ রটনার অভিযানের বিরুদ্ধে একটি ক্রুদ্ধ ভাষণ দেবার বা মুসলমানদেরকে পাল্টা আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে মুসলমানদেরকে এ শিক্ষা দেবার প্রতি তাঁর সার্বিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন যে, তোমাদের নৈতিক অংগনে যেখানে যেখানে শূন্যতা রয়েছে সেগুলো পূর্ণ কর এবং এ অংগনকে আরো বেশী শক্তিশালী করো । একটু আগেই দেখা গেছে যয়নবের (রা) বিয়ের সময় মুনাফিক ও কাফেররা কী হাংগামাটাই না সৃষ্টি করেছিল । অথচ সূরা আহযাব বের করে পড়লে দেখা যাবে সেখানে ঠিক সে হাংগামার যুগেই সামাজিক সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত নির্দেশগুলো দেয়া হয়ঃ

একঃ নবী করীমের (সা) পবিত্র স্ত্রীগণকে হুকুম দেয়া হয়ঃ নিজেদের গৃহমধ্যে মর্যাদা সহকারে বসে থাকো, সাজসজ্জা করে বাইরে বের হয়ো না এবং ভিন পুরুষদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে বিনম্র স্বরে কথা বলো না, যাতে কোন ব্যক্তি কোন অবাঞ্ছিত আশা পোষণ না করে বসে । ( ৩২ ও ৩৩ আয়াত)

দুইঃ নবী করীমের (সা) গৃহে ভিন পুরুষদের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নির্দেশ দেয়া হয়।